শিক্ষা-সংস্কৃতির পাদপীঠখ্যাত কুমিল্লা জেলা প্রশাসনে বেড়েছে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা। তারা নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। কর্মক্ষেত্র এলাকায় তারা হয়ে উঠছেন জনপ্রিয়ও। বর্তমানে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের অধীন কাজ করছেন ৬২ জন (নারী-পুরুষ) বিসিএস কর্মকর্তা।
এদের মধ্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসি-ল্যান্ড)সহ বিভিন্ন পদে রয়েছেন ২২ জন নারী, যা ৩৫ শতাংশেরও বেশি। আশার কথা হচ্ছে—তিন দশক আগেও রক্ষণশীল ছিল বাঙালি সমাজ, নারীদের বাইরে কাজ করতে বাধা দেওয়া হতো। কিন্তু কোনো কোনো পরিবার আবার উত্সাহ দিয়েছে। তাদের সাফল্য দেখে অন্যরা অনুপ্রাণিত হয়েছে। দিনে দিনে পড়ালেখা আর চাকরিতেও বাড়ছে নারীর সংখ্যা। তবে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই মন্তব্য করে আরো এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নের কথা বলেছেন তারা। তাদের নিয়েই তৈরি করা হয়েছে এ প্রতিবেদন।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ জেলায় বিভিন্ন পদে ২২ জন নারী দায়িত্ব পালন করছেন। এরমধ্যে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে রয়েছেন ৯ জন নারী কর্মকর্তা। তারা হলেন : রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর পদে মাহফুজা মতিন, সহকারী কমিশনার পদে নাছরিন সুলতানা, তানজিমা আঞ্জুম সোহানিয়া, শারমিন আরা, তাছলিমা শিরিন, বেগম শামীম আরা, বেগম তানিয়া আক্তার, নাসরিন সুলতানা নিপা ও সৈয়দা ফারহানা পৃথা। জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ছয়টিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) দায়িত্বে আছেন ছয় জন নারী। তারা হলেন :জাকিয়া আফরিন (আদর্শ সদর), লামইয়া সাইফুল (নাঙ্গলকোট), বেগম ফৌজিয়া সিদ্দিকা (ব্রাহ্মণপাড়া), তাপ্তি চাকমা (হোমনা), মোছাম্মত্ রাশেদা আক্তার (তিতাস) ও বেগম আফরোজা পারভীন (মেঘনা)। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে আছেন সাত জন নারী। তারা হলেন :বেগম নাঈমা ইসলাম (চান্দিনা), বেগম নাহিদা সুলতানা (বরুড়া), তাহিমদা আক্তার (বুড়িচং), তাছলিমুন্নেসা (সদর দক্ষিণ), উজালা রানি চাকমা (লাকসাম), সাহিদা আক্তার (দেবিদ্বার) ও তানিয়া ভূঁইয়া (হোমনা)।
সহকারী কমিশনার শারমিন আরা বলেন, ‘নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই। বিরুদ্ধ পরিবেশেও নারীরা সাফল্যের প্রমাণ দিয়েছেন। এখন সবাই বুঝতে পারছে নারীদের বাদ রেখে উন্নয়নের সোপানে পৌঁছানো সম্ভব না।’ সহকারী কমিশনার নাছরিন সুলতানা বলেন, ‘কাজ করতে চাইলে নারী-পুরুষ কোনো ব্যাপারই না। অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, নারী হওয়ায় আলাদা কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়িনি।’ বুড়িচংয়ের এসি-ল্যান্ড তাহিমদা আক্তার। তিনি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার বালিয়াপাড়া গ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাসাদ্দেক হোসেন এবং ওয়াহিদা বেগমের মেয়ে। তাহিমদা বলেন, আমার বাবা একজন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা—এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো গর্ব। তিনি বলেন, ‘এ পদে থেকে শুধু ভূমি সংক্রান্ত কাজই নয়, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, গণশুনানি, তদন্তসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হয়। একজন পুরুষ যেভাবে দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন, আমিও তা করছি।’ চান্দিনার এসি-ল্যান্ড বেগম নাঈমা ইসলাম বলেন, ‘আমরা নারী বা পুরুষ হিসেবে নয়, একজন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছি। মাঠে কাজ করতে গিয়ে তেমন প্রতিবন্ধকতা পাইনি বা বাধাপ্রাপ্ত হইনি। অনেক সময় রাতেও কাজ করি। সমাজও আমাদের সহযোগিতা করে, নিজেরা কমফোর্ট ফিল করছি। এখন আমাদের সমাজ অনেকটাই পালটে গেছে।’
আদর্শ সদরের ইউএনও জাকিয়া আফরিন ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার বাঘাদাঁড়িয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান ও মিসেস ফয়েজুন্নাহারের মেয়ে। জাকিয়া আফরিন বলেন, এ পদে থেকে জনগণকে সরাসরি সেবা দেওয়ার সুযোগ আছে। তবে অনেক সময় পরিবার, সন্তান ও স্বজনদেরকে সময় দিতে পারি না। এরপরও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছি। এক্ষেত্রে প্রাপ্তিটাই বেশি। তিনি বলেন, সরকারের ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা নারী-পুরুষ সম-অংশীদার হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছি।
কুমিল্লার নারীনেত্রী অ্যাডভোকেট ফাহমিদা জেবিন বলেন,‘নারীরা জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হচ্ছেন। এটা অবশ্যই সম্মানের। নারীর ক্ষমতায়নেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নারীদের আরো এগিয়ে যেতে হবে। প্রশাসনে নারী অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে, এটা অবশ্যই ভালো দিক। তবে এই সংখ্যাটা আরো বাড়তে হবে।’
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর জানান, ‘নারীর ক্ষমতায়নে সরকার বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকারের নীতিনির্ধারণ ও মাঠ প্রশাসনে নারীদের অংশগ্রহণ অধিকতর বৃদ্ধি করতে সরকার বাজেট বৃদ্ধি করছে, নানা কর্মকৌশল প্রণয়ন করছে এবং তাদের সব ধরনের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করেছে।